RAHE VANDER TARIQA

খেলাফতে মুহাম্মদী অস্বীকার করে উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা ছিল রাজনৈতিক শঠতা: ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ

লেখক: শাহজাদা ছৈয়দ মোহাম্মদ ছরোয়ার আলম মিডু, খলিফায়ে রাহে ভান্ডার, চট্টগ্রাম দরবার শরীফ:

বাকলিয়া নিবাসী রাহে ভান্ডার তরীকার অনুসারী ছুফিগণের আয়েজনে ছুফি বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আল্লামা ছুফি ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ (মা.) বলেন: খেলাফতে মুহাম্মদী অস্বীকার করে উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা ছিল সেদিনের স্বার্থবাদী রাজনৈতিক কুচক্রি মহলের শঠতার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ।

গতকাল 17 জানুয়ারী সোমবার রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর 19 নং ওয়ার্ডে অবস্থিত খানকায়ে রাহে ভান্ডার- বাকলিয়াতে ব্যাপক আয়োজন ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয় মাসিক ছুফি বৈঠক বা মান্থলি ছুফি সেশান, যাকে আরবিতে আল্ জলসাতুস ছুফিয়াত্ শাহরিয়াহ্ (الجلسة صوفية شهرية) বলা হয়ে থাকে।

বিগত ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৫ বাংলা, ০৮ রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হিজরী, ১৭ নভেম্বর ২০১৮ ইংরেজী তারিখে চট্টগ্রাম মহানগরস্থ হাজী ওছমান খান সও: বাড়ী, মিয়া খান নগর, দ.বাকলিয়ায় রাহে ভান্ডার খানকাহ শরীফের শুভ উদ্ভোধন করেন রাহে ভান্ডার তরিকার পীর ও মুর্শিদ এবং চট্টগ্রাম দরবার শরীফের মহান সাজ্জাদানশীন হযরতুল আল্লামা ছুফি ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ (মা.)। সে সময় হতে প্রতি বাংলা মাসের ৩ তারিখ এ ছুফি বৈঠক নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

এশার নামাজের পর আয়োজিত উক্ত পবিত্রানুষ্ঠানে রাহে ভান্ডার তরিকার গ্রান্ড শায়েখ আল্লামা ছুফি ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ (মা.) তরিকার পথে অগ্রসরমান আত্ম তত্ত্বানুসন্ধিৎসু পথিকগণের উদ্দেশ্যে ধর্মের নিগুঢ় তত্ত্ব ও চলমান পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি নিয়ে দীর্ঘ এক ঘন্টা ব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করেন।

তিনি ছুফিদের আধ্যাত্মিক হাল বা জজব্ হাল বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত মওলানা রুমী (র.)’র কালাম উল্লেখ করে বলেন, মানুষের এক মুহূর্তের জজব্ হাল, শত বছরের বে-রিয়া (গোপন) ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ জজব্ হাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভোর হয়ে সামার (ঐশি সংগীত/কাওয়ালি) মধ্যে যখন মানুষ আল্লাহর দিকে রুজু (মনস্থ) হয়, ঐ ভাবকেই তিনি ইশারা করেছেন। জজব হাল মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তীতে অবস্থান করায় বলে দাবী করেন।

তকরীরে আলোকপাত করা বহুবিধ বিষয়ের মাঝে সমকালিন ফতোয়াবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, কোন মানুষের কথা চুড়ান্ত কথা নয়। কোন মোল্লা-মুন্সির কথা চুড়ান্ত নয়।  সব সময় সকল কিছু চুড়ান্ত হল আল্লাহর। বান্দার কোন কিছুই চুড়ান্ত নয় আল্লাহর কালাম ব্যতিত। আল্লাহ মানুষকে রুহ দিয়েছেন। কোন পীর, ফকির, নবী, ওলী বা গাউছ- কুতুব এটি দেননি। আল্লাহ ডাইরেক্ট দিয়েছেন। রুহ দিয়েছেন। অনুরুপ ভাবে ক্বলব, আকল, এলম, হুশ, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, ঘ্রানেন্দ্রীয় সহ ধরার জন্য হাত, চলার জন্য পা ইত্যিাদি দিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, এগুলিকি কোন স্কুল বা মাদ্রাসা হতে কিংবা কোন পীর- ফকির, মোল্লা-মুন্সি দিয়েছে? ডাইরেক্ট কুদরতি ভাবে আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ কি আপনাকে তা ব্যবহার না করার জন্য দিয়েছেন? তা ব্যবহারের অধিকার দেননি? আপনি তা ব্যবহার করছেনও। কিন্তু ধর্মী বিষয়ে যখন আসে তখন মানুষ বলে, না।  হুজুর যা বলেন তাই হবে।  কেন! আল্লাহ প্রদত্ত হুশ, চোখ, কান, জ্ঞান এসব আপনি সেখানে ব্যবহার করা হতে বিরত থাকবেন? সেগুলির সাথে যদি মোল্লার কথা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবেই তা গ্রহণ করবেন। নতুবা মোল্লারা বলবে, অমুক কিতাবে আছে, এমন। সমুক কিতাবে আছে, তেমন। ইত্যাদি। মোল্লারা প্রায় সকল কিছুকে ভেজাল করে ফেলেছে। আজ হঠাৎ করে নয়। আগে থেকে তা হয়ে এসেছে।

তিনি স্ববিস্তারে বলেন,  নবী (সঃ)’র আওলাদে পাকগণকে মুরুভূমিতে নির্বাসন দিয়ে, উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসে হযরত আবু বক্বর ছিদ্দিক (র.), হযরত ওমর ফারুত (র.), হযরত ওসমান জুন্নুরাইন (র.) এবং হযরত আলী (র.)- এ চারজনকে খোলাফয়ে রাশেদিন বা নবী (সঃ)’র চারজন খলিফা বলা হয়। এ খোলেফায়ে রাশেদাগণ নবী (সঃ)’র পথে, পথ দেখিয়েছেন।

এর পরের খলিফা মু’য়াউইয়া (মাবিয়া) হতে উমাইয়া খেলাফত। উমাইয়াতো আমাদের নবী নন। উমাইয়া কি আমাদের নবী ছিলেন? তাহলে মু’য়াউইয়াতো উমাইয়ার খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে। উমাইয়া যে আমাদের নবী নন এটি একশত ভাগ সত্য। কোন কিতাবের দরকার নাই। আকল নাই তোমাদের? বিবেক নাই? আমাদের নবী মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)।

আমার নবী (সঃ)’র খেলাফতকে পাশকাটিয়ে, মু’য়াউইয়া উনার পূর্ব বংশিয় উমাইয়া রাজত্য কায়েম করেছে। ঐ উমাইয়া রাজত্ব যদিও ইসলামের সাথে সংমিশ্রিত করা হয়েছে, তবে তাতে ভেজাল ছিল।

আমরা উমাইয়ার উম্মত নই। আমরা মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)’র উম্মত। উমাইয়া খেলাফতকে পাকাপোক্ত এবং তাদের শাসন ব্যস্থাকে সুসংহত রাখার জন্য তারা দ্বীনকে তাদের নিজের ইচ্ছা মোতাবেক বানিয়েছে। এখানে অনেক কিছু রয়েগেছে।

আমার নবী (সঃ)’র এক হাদিস, “আমি তোমাদের কাছে দুইটি পবিত্র বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি আল্লাহর কোরআন অন্যটি হল আমার আহলে বাইয়্যাত। আমার আওলাদগণ।” এ হাদিসটিকে ভেজাল বানিয়ে কি বলছে? এটিকে ভেজাল করে বলছে, “আমি কোরআন এবং হাদিস রেখে গেছি তোমাদের জন্য”।

আচ্ছা, তোমাদের কি জানা আছে? আমার নবীজি (সঃ)’র আমলে কোন হাদিসের অস্থিত্ব ছিল? কেউ প্রমাণ করতে পারলে দেখা যাবে।

আমার নবীজি (সঃ)’র দুনিয়া হতে বিদায় নেয়ার আড়াইশত বৎসর পরে এ হাদিস সমূহ সংরক্ষিত হয়েছে। তাহলে নবীজি (সঃ) কিভাবে বলেছিলেন, “আমি তোমাদের কাছে কোরআন এবং হাদিস রেখে গিয়েছি”?

নবীজি (সঃ)’র আমলেতো হাদিস ছিলনা। তাহলে এ কথাটি ভেজাল নয়? তখন বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ ইবনে মা’যাআ সহ হোন হাদিসেরইতো অস্থিত্ব ছিলনা। তাহলে হাদিস রেখে যাওয়ার যে হাদিসটি বলছে, তা কি সত্য (হতে পারে)? আমার বিবেক তো বলছে, তখনতো হাদিস ছিলনা।

অথচ অন্য দিকে আমার নবী (সঃ) যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তিনি কোরআনও রেখে গিয়েছেন। উনার আহলে পাকও (আওলাদও) রেখে গিয়েছেন। এটাই চুড়ান্ত সত্য।

আকল, বিবেক দ্বারা আমরা বুঝতে পারছি। কোন কিতাব লাগে না। কোন কিতাবের প্রয়োজন নাই। কোরআন এবং নবী (সঃ)’র আহলে বাইয়্যাতগণ ছিলেন।

আপনারা বলুন, আওয়ামী লীগ বা ক্ষমাতাসীন দলের বিরুদ্ধে কি কেউ বেশি কিছু লিখতে পারবে? সম্ভব নয়। সেটা এখন যেমন, তখনও সম্ভব ছিল না। কারন ওরা ক্ষমতায় ছিল। এখন যত বুদ্ধিজিবী আছে সব আওয়ামী লীগ। তাই না? অন্য কোন লিগ আছে? নাই। অথচ পনের বছর আগে সব বিএনপি ছিল।

অনুরুপ, যে যুগে যে শাসন তন্ত্র, সেই শাসন তন্ত্রের পক্ষেই ধর্মীয় নীতি সমূহকে তারা চালিয়ে নিয়েছে। চালিয়ে নিয়েছে ঐ শাসন তন্ত্রকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য।

উমাইয়া খেলাফত শেষ হওয়ার পরে আব্বাসিয় খেলাফত এসেছে। হযরত আব্বাস কি নবী ছিলেন? আব্বাসিয় গোত্রের কেউ এসে যদি খেলাফতে মোহাম্মদী প্রতিষ্ঠা করত তাহলে আমরা বুঝতাম, আমাদের ইসলামকেই তারা প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা তো খেলাফতে মোহাম্মদী প্রতিষ্ঠা করেনি। তারা খেলাফতে আব্বাসি প্রতিষ্ঠা করেছে।

আগে উমাইয়া ছিল পরে আব্বাসিয়। বস্তুত এই চাটুকার থেকে ঐ চাটুকার। যেমন বিএনপি থেকে জেনারেল এরশাদ। এরা কি আওয়ামী লীগ? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কি এর করেছিল? এদের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে?

তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন,  এভাবে বুঝতে হবে, কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে। উমাইয়াদের নিকট হতে কেড়ে নিয়ে আব্বাসিয়রা খেলাফত চালিয়েছে। এ দীর্ঘ সময় বহু কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের নাম নেয়ার লোক ছিলনা। অত্র বাকলিয়া হতে প্রতিবাদ করেছিল, মৌলভি ছৈয়দ, বাঁশখালির। উনার লাশটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সুতরাং নবীজি (সঃ)’র চার খলিফার পরে যা কিছু ইসলাম বলছে, সেগুলি জগা-খিচুড়ি ইসলাম। এগুলির উপর আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারি- না। একেবারে বিশ্বাস করবনা, এমন কথা নয়।

কিন্তু আমাদের বিবেক বুদ্ধি, হুশ, আকল, জ্ঞান, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা এগুলির সদ্বব্যবহার করে যা মিলে তাকে আমরা গ্রহণ করব।  আমরা কোন মোল্লা মুনসির ফতোয়া দ্বারা গ্রহণ করব না।

উক্ত মাহফিলে এলাকার বিভিন্ন স্থরের আশেক- ভক্তবৃন্দ সহ উপস্থিত ছিলেন খলিফায়ে রাহে ভান্ডারী  শাহজাদা ছৈয়দ মোহাম্মদ সাইফুল আলম নাইডু।

প্রধান অতিথির তকরীরের পর দরুদ- সালাম ও সামা মাহফিলে কাওয়ালী পরিবেশন করেন বিশিষ্ঠ মাইজভান্ডারী সঙ্গীত শিল্পী জনাব আবু কাওয়াল ও তার দল।

আল্লামা ছুফি ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ (মা.)’র নির্দেশনায় খলিফায়ে রাহে ভান্ডারী শাহজাদা ছৈয়দ মোহাম্মদ ছরোয়ার আলম মিডুর পরিচালিত মুনাজাতের মধ্য দিয়ে এ মহতি ছুফি বৈঠকের সমাপ্তি ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *